শিরীন সেনগুপ্ত
সেই কবে থেকে যেন প্রচলিত এই আগমনী গানটির বাণীর মত আমার পরম শ্রদ্ধেয় ‘গুরুজি’- পণ্ডিত অরুণ ভাদুড়ী মহাশয় খুলে দিয়েছিলেন ওঁরজ্ঞানের আলোর দুয়ার – উদারহস্তে, অকুণ্ঠচিত্তে। আর তাঁর সেই “দুয়ার খোলার ধ্বনি” আজও “বাজে, হৃদয়মাঝে”।
‘গুরু’ সম্বন্ধে কিছু লেখার গুরুভার বহিব কেমনে, সে যে ভারী ধৃষ্টতা! জানি না কোথায় গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়তে হবে। গলতি যখন হবেই তখন প্রথাগত বাঁধা গতের নিয়ম ভেঙে একটু শেষের দিক থেকেই শুরু করি।
সালটা ২০১৬। মার্চ মাসের প্রচণ্ড রোদ্দুরে গলদঘর্ম হয়ে একদিন ভর-দুপুরবেলা ছুটেছিলাম গুরুজির বাড়ি, টালিগঞ্জে। উদ্দেশ্য – গুরুজির কাছ থেকে জোরজার করে একটা composition সংগ্রহ করা। না না, পুরনো নয়। একেবারে নতুন কিছু উদ্ভাবন। দুটি প্রধান কারণ ছিল এ-হেন আবদারের। প্রথমত গুরুমার নিঃশব্দ ইঙ্গিত – “গুরুজিকে জোর করে নতুন কিছু Compose করতে বল। নাহলে ইদানীং শুধুই television এর দিকে তাকিয়ে থাকে” (যদিও ততদিনে গুরুজি-র লেখা অনেকগুলো বই বেরিয়েছে আর যথারীতি সেগুলো সব পড়েও ফেলেছি)। তবু জেঠিমার কথাটা মাথায় ছিলই। তার ওপর অভাবনীয়ভাবে সেবার ঠিক হল ‘মনমঞ্জরী’-র (আমাদের সঙ্গীত শিক্ষায়তন) নবম বার্ষিক অনুষ্ঠানে বিদুষী পূর্ণিমা সেন মহাশয়াকে সম্বর্ধনা দেওয়া হবে। ভাবলাম এই তো সুযোগ। পূর্ণিমাদি-র মত এমন একজন বিদুষী গুণী শিল্পীকে অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানিয়ে যেমন-তেমন গানবাজনা কি শোনানো যায়? আগ্রা ঘরানার খানদানি তালিমদার শিল্পী। ওঁকে যদি কিছু নতুন কিন্তু খাসতালিমী বন্দিশ শোনাতে পারি তবে আমার ছেলেমেয়েরা বড় আশীর্বাদধন্য হবে। তো এই মনে করে, এই আশা নিয়ে গেলাম গুরুজির কাছে।
গুরুজি যথারীতি ওঁর চিরাচরিত ভঙ্গিমায় গালে হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে বসে আপনমনে দুলছিলেন। আমাকে দেখেই বললেন – “কী রে? এখন কোত্থেকে এলি? এই ভর-দুপুরবেলা?” আমি কোনও কথা না বলে শুধু বললাম – “গুরুজি, মনমঞ্জরী-র Annual Programme আছে। আপনার শেখানো অনেকগুলো বন্দিশ তো ছেলেমেয়েদের করাচ্ছি। ভজনও করাচ্ছি। কিন্তু সকালের রাগশুধ্ সারং-এর composition-টা ছেলেমেয়েরা ঠিক গাইতে পারছে না। বড্ড খাদে, গলা যাচ্ছেই না। একটা তরানা বেঁধে দিন না। দিতেই হবে কিন্তু।” কথাটা নিজের কানে যেতে নিজেই চমকে উঠেছিলাম। এ কোন আমি?! এই কি সেই, যে কিনা আজ থেকে তেত্রিশ বছর আগে এ আবদার করার কথা চিন্তা তো দূর, উল্টোডাঙা থেকে টালিগঞ্জ পৌঁছে এক গ্লাস জল চাইতেও অহেতুক ভয়ে বা শ্রদ্ধায় সিঁটিয়ে থাকত? আসলে তখন তো আমার ভয় বা শ্রদ্ধা-সম্ভ্রম আলাদা করে বোঝার মত বোধই গড়ে ওঠেনি। কিছু বলার বা বুঝে ওঠার আগেই আমাকে চোখ খুলে একঝলক দেখেই গুরুজির অমোঘ আদেশ নির্দেশিত হত– “তানপুরাটা নে”। আর তারপর “জগত জুড়ে উদার সুরে” শুধু আনন্দগানই বেজে চলত, বেজেই চলত। আজও যেমন তা বেজেই চলেছে।
আবার ফিরে আসি সেদিনের কথায়, যেদিন আমার এহেন আবদার – আস্পর্ধাও কী এক মন্ত্রবলে গুরুজির কানে যেন অন্যভাবে পৌঁছল। আসলে আজীবনের সাধক স্রষ্টা মানুষটি বরাবরই ছিলেন আপনভোলা – সুরের বাঁধনে, উদ্ভাবনের নেশায় সর্বদাই মশগুল বা বলা ভালো বুঁদ হয়ে থাকতেন। তাই আমার কথার নয়, composition-এর approach-টাই ওঁকে ডুবিয়ে দিল সুরের চিন্তায় (আর আমাকে বাঁচিয়ে দিল সটান ঘাড়ধাক্কার হাত থেকে)। এবং আবার সেই আদেশ – “তানপুরাটা চালা তো”।
আপনমনে গুনগুন করতে করতে চোখের সামনে তৈরি হতে লাগল আরও একটি ‘Masterpiece’। যদিও এর আগে বহুবার ওঁর এরকম বহু composition-এর আমি সাক্ষী ছিলাম, তবে তখন এ-বিষয়ে ততখানি গভীরভাবে অবগত ছিলাম না যতখানি না এই পরিণত বয়সে এসে উপলব্ধি করতে পারছি বা পারতে চেষ্টা করে চলছি। কী অসাধারণ ওঁর শৈল্পিক চিন্তাভাবনা, অথচ রাগদারির কি বিধিসম্মত প্রয়োগ নৈপুণ্য! সম্পূর্ণ স্বকীয় অথচ কী বিশুদ্ধ সঙ্গীতবোধ! খাসতালিমী অথচ কী স্বতঃস্ফূর্ত উদ্ভাবনী শক্তি! মাথা নত হয়ে এসেছিল। না, এবার আর ভয়ে নয়, সত্যিকারের শ্রদ্ধা-সততার কাছে। আবার একবার অনুভব করেছিলাম তাঁর চারিত্রিক দৃঢ়তা, তাঁর সাত্ত্বিক,রুচিশীল অথচ সহজ জীবনযাপন, তাঁর উদার মনোভাবাপন্ন মনুষ্যত্ববোধ এবং সর্বোপরি অকৃপণ স্নেহবাৎসল্যের মধ্যে দিয়ে দান করা তাঁর বিদ্যা-শিক্ষাকে। এই সবকিছুই তাঁর সমগ্রতাকে সেই পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল, যেখান থেকে আপামর শ্রোতা- দর্শক –সাধারণ বা বিশিষ্ট – সবাই তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা ও সমীহ বোধ করেছিলেন তাঁর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত।
আরও একটু “পিছনের পানে চাই”। যদিও আমার এ-স্মৃতিচারণার কোনও সুচারু অন্ত আমি টানতে পারব না তাই কয়েকটা টুকরো-টুকরো ঘটনাই তুলে ধরার চেষ্টা করলাম।
সালটা ২০১৪। গুরুজি এসেছিলেন মনমঞ্জরী-র অনুষ্ঠানে। যদিও শারীরিক অসুস্থতার আগে অবধি গুরুজি প্রতিবারই আমাদের অনুষ্ঠানে বিশেষ সম্মানিত অতিথি হয়ে আসতেন আর আমাদের সবাইকে আশীর্বাদ করে যেতেন, তবু সে-বছর গুরুজিকে আমরা আরও একটু বিশেষভাবে পেয়েছিলাম আমাদের দুজনের (আমার এবং আমার স্বামী শ্রী রণজিৎ সেনগুপ্তের) দু’টি compact disk-এর উদ্বোধক-আশীর্বাদক রূপে। সে যে কী অদ্ভুত এক অনুভূতি তা বর্ণনার অতীত। একদিকে অসীম-অপার লজ্জা অন্যদিকে অপরিসীম-অগাধ আনন্দ। গুরুজি সেদিন নিজে হাতে সকলের সামনে আমাদের যে স্বীকৃতি তুলে ধরেছিলেন তা আমাদের জীবনের মার্গে সঠিক গতি-লয়-ছন্দের ভারসাম্য বজায় রাখতে অনুপ্রেরণা দান করে যাবে, আজীবন।
তারও বছর দুয়েক আগে – ২০১২ সালে– মনমঞ্জরী-র কচিকাঁচারা যখন গুরুজিকে সম্বর্ধিত করেছিল তাদের আন্তরিক শ্রদ্ধা-সম্মান জ্ঞাপনের মাধ্যমে,তখনও গুরুজি তাঁর প্রাণভরা স্নেহাশীর্বাদ জানিয়ে আমাদের সকলের মঙ্গলকামনা করেছিলেন এই বলে যে, “ভবিষ্যতে তোমরা আরও এগিয়ে যাও। আমার দীর্ঘদিনের স্নেহধন্য রানা (সরোদিয়া পণ্ডিত রণজিৎ সেনগুপ্ত) ও ছাত্রী শিরীনের এই প্রচেষ্টাকে আমি সাধুবাদ জানাই, আর ওদের তৈরি করা ছাত্রছাত্রীদের (যারা ওঁর ঘরানার উত্তরসূরি ও তৃতীয় প্রজন্ম) মঙ্গলকামনা করি।” সেদিনের ওই আশির্বচন ছিল আমাদের সবার পরমপ্রাপ্তি। প্রতিবার উনি নিজে হাতে প্রতিটি ছাত্রছাত্রীকে ‘certificate-medal’ তুলে দিতেন এবং আদর করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন। তাঁর সেই প্রতিটি ‘স্নেহস্পর্শ’ আমরাও অনুভব করতাম আর পরম ধন্য হতাম।
কোথাও না কোথাও ইতি তো এবার টানতেই হয়। এই শেষ পর্বে এসে বড় ইচ্ছা করছে ‘আমার মেয়েবেলা’র দিকে একটু ফিরে তাকানোর। ফিরে যাই আমার শিক্ষাজীবনের প্রথম দিকে যেখান থেকে আমার আজকের অস্তিত্বের ভিতটি স্থাপন করেছিলেন আমার গুরুজি শ্রদ্ধেয় পণ্ডিত অরুণ ভাদুড়ী মহাশয়। জানি অনেক কথার ভিড়ে লেখা বড় অগোছালো হয়ে পড়েছে, তবু এটুকু না বললে ওঁরপ্রতি হয়তো অন্যায় হবে। গুরুজি-র গুরু, আমাদের “বড় গুরুজি” তাঁর যে “জ্ঞানের প্রকাশ” ওঁর (অরুণজেঠুর) মধ্যে দিয়ে প্রচারিত করতে চেয়েছিলেন,তার প্রতিচ্ছবিটিওঁর পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে যেন পরিপূর্ণতা ও প্রসারতা লাভ করেছে। আজ সমগ্র কোলকাতা তথা সারা ভারতবর্ষ সর্বোপরি সারা পৃথিবী জুড়ে ওঁর ছাত্রছাত্রীরা ওঁর শিক্ষাকে ছড়িয়ে দেবার বিশেষ প্রচেষ্টায় অঙ্গীকারবদ্ধ। সেই ১৯৮৫ সালের শেষভাগ থেকে আজ অবধি আমিও সে দায়িত্বপালন করার চেষ্টা করে চলেছি। ১৯৮৪ সালে “ITC SANGEET RESEARCH ACADEMY”র ‘PREFECT’- অরুণজেঠুকে পরে যখন যতবারই “গুরুজি” বলে সম্বোধন করেছি, ততবারই একটু-একটু করে বিশুদ্ধ ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রতি ক্ষুৎপিপাসা বাড়তে থেকেছে আর ততবারই গুরুজিও তাঁর জ্ঞানের ভাণ্ডার উজাড় করে দিয়েছেন। তাই আজ গর্ববোধ নয়, ওঁর মন্ত্রশিষ্যা রূপে নিজেকে ধন্য ও তৃপ্ত মনে করি এই ভেবে, যে গুরুজির প্রথম সৃষ্টি করা বন্দিশ (ভোর ভয়ো চিড়িয়া বোলে বনমে) থেকে শেষ তরানাটি (নিত্রোম তাদিয়া নারে তানোমতাদারেদানি) পর্যন্ত সংগ্রহের মাধ্যমে আমার শিক্ষার ঝুলিটি পূর্ণ হয়ে রইল। চেষ্টা করে যাব ওঁর বৈশিষ্ট্যপূর্ণ গায়কী, নান্দনিক সঙ্গীতবোধ ও রাগদারির শুদ্ধতা পরবর্তী প্রজন্মের হাতে তুলে দেবার – ওঁরই প্রদর্শিত সাধনার পথ ধরে, লক্ষ্যে অবিচল থেকে, আজীবন।